বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জীবনাবসান
স্টাফ রিপোর্টার । ঢাকা | প্রকাশিত: ৩০ ডিসেম্বর ২০২৫, ০৯:২৬
বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপির চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া আর নেই। ৮০ বছর বয়সে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)।
চার দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের রাজনীতিতে অন্যতম প্রধান চরিত্র ছিলেন খালেদা জিয়া। গৃহবধূ থেকে রাজনীতিতে এসে মাত্র এক দশকের মধ্যেই দলকে ক্ষমতায় এনে তিনি ইতিহাস গড়েন।
সংসদীয় গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তনের রূপকার
১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিজয়ের মাধ্যমে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। ওই নির্বাচনের পর পঞ্চম সংসদে রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন তিনি। এর মধ্য দিয়ে দীর্ঘ ১৬ বছর পর বাংলাদেশে আবার সংসদীয় গণতন্ত্র ফিরে আসে।
পুতুল থেকে খালেদা জিয়া
খালেদা জিয়ার জন্ম ১৯৪৬ সালের ১৫ আগস্ট তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের জলপাইগুড়িতে। তার পুরো নাম খালেদা খানম। পরিবারের কাছে তার ডাকনাম ছিল ‘পুতুল’। ১৯৬০ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে তার বিয়ে হয়। বিয়ের পর তিনি স্বামীর নামের সঙ্গে মিলিয়ে ‘খালেদা জিয়া’ নাম গ্রহণ করেন।
১৯৮১ সালে জিয়াউর রহমান নিহত হওয়ার পর মাত্র ৩৬ বছর বয়সে বিধবা হন তিনি। দুই সন্তান—তারেক রহমান ও আরাফাত রহমানকে নিয়ে তখন তিনি ছিলেন একজন সাধারণ গৃহবধূ।
দলের বিপর্যয়ে হাল ধরেন যেভাবে
জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর বিএনপি ভয়াবহ সংকটে পড়ে। একাধিক নেতা সামরিক শাসক এরশাদের সঙ্গে যুক্ত হন। সেই সংকটময় সময়ে ১৯৮৩ সালের ৩ জানুয়ারি খালেদা জিয়া বিএনপিতে যোগ দেন এবং ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ১৯৮৪ সালের ১০ মে তিনি বিএনপির চেয়ারপার্সন হন।
আপোষহীন আন্দোলনের নেতৃত্ব
জেনারেল এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে নয় বছরের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে খালেদা জিয়া ‘আপোষহীন নেত্রী’ হিসেবে পরিচিতি পান। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে তিনি তিনবার গ্রেপ্তার হন। বিএনপি নেতাদের মতে, এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই তিনি দলকে পুনরুজ্জীবিত করেন।
প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দলীয় নেতা ও আবার ক্ষমতায়
১৯৯১ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর ১৯৯৬ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনের মুখে একদলীয় নির্বাচন আয়োজন করেন তিনি। তবে আন্দোলনের চাপে মাত্র ১২ দিনের মাথায় সংসদ ভেঙে দিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন।
২০০১ সালে আবার ক্ষমতায় এসে তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হন খালেদা জিয়া। ২০০৮ ও ২০১৪ সালের নির্বাচনে পরাজয় ও বর্জনের মাধ্যমে তিনি দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকেন।
দুর্নীতি মামলা, কারাবাস ও অসুস্থতা
২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এবং ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুর্নীতির মামলায় কারাবরণ করেন খালেদা জিয়া। দীর্ঘ কারাভোগের পর গুরুতর অসুস্থতার কারণে নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পান।
তিনি দীর্ঘদিন ধরে লিভার সিরোসিস, হৃদরোগ, কিডনি সমস্যা, ডায়াবেটিস ও আর্থরাইটিসে ভুগছিলেন। ২০২৪ সালে তার হৃদপিণ্ডে পেসমেকার বসানো হয় এবং লিভারের জটিল চিকিৎসাও নেওয়া হয়।
পাঁচ আগস্টের পর মুক্তি ও সীমিত রাজনৈতিক উপস্থিতি
২০২৪ সালের ৫ আগস্ট গণআন্দোলনের পর নির্বাহী আদেশে মুক্তি পান খালেদা জিয়া। এরপর সীমিত পরিসরে তিনি রাষ্ট্রীয় ও কূটনৈতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেন। বয়স ও অসুস্থতার কারণে সক্রিয় রাজনীতিতে না থাকলেও বিএনপি তাকে সবসময় রাজনৈতিক অভিভাবক হিসেবে বিবেচনা করেছে।
দুই নেত্রীকেন্দ্রিক রাজনীতির অবসান
বিশ্লেষকদের মতে, নব্বইয়ের দশক থেকে দীর্ঘ সময় বাংলাদেশের রাজনীতি খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনাকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়েছে। তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সমাপ্তি ঘটলো।
তথ্যসূত্র: বিবিসি বাংলা
বিষয়:

পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।