বৃহঃস্পতিবার, ৯ অক্টোবর ২০২৫, ২৪ আশ্বিন ১৪৩২

বিপ্লবের স্থপতি কমরেড ফরহাদ: আদর্শিক সংগ্রামে এক মহাকাব্যিক জীবনের প্রতিচ্ছবি

নিউজফ্ল্যাশ ডেস্ক | প্রকাশিত: ৯ অক্টোবর ২০২৫, ১৫:০৮

ছবি: সংগৃহীত

বাংলার মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদের নাম উচ্চারিত হয় এক অনন্য মর্যাদায়। পঞ্চগড়ের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে উঠে আসা এই তরুণ বিপ্লবী মাত্র সতেরো বছর বয়সেই সমাজতান্ত্রিক আদর্শে দীক্ষিত হয়েছিলেন। ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে জাতীয় চেতনার স্ফুরণ ঘটেছিল, সেই চেতনা ফরহাদের হাতে রূপ নেয় অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে। তিনি ছয় দফার সঙ্গে শ্রমিক-কৃষকের এগারো দফা দাবি যুক্ত করে ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানকে এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছে দেন।

কমরেড ফরহাদ ছিলেন শুধু আন্দোলনের সংগঠক নন, ছিলেন আদর্শের স্থপতি। মুক্তিযুদ্ধের সময় ন্যাপ-সিপিবি-ছাত্র ইউনিয়নের গেরিলা বাহিনী গঠনে তাঁর ভূমিকা ছিল মুখ্য। ইন্দিরা গান্ধীর বাসভবনে অস্ত্র সংগ্রহের আলোচনায় তাঁর উপস্থিতি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের সংবিধানে সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার মূলনীতিগুলো অন্তর্ভুক্ত করার পেছনেও ফরহাদের নেতৃত্বাধীন তরুণ কমিউনিস্টদের ভূমিকা ছিল অপরিসীম।

১৯৭৩ সালে তিনি হন বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক—তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সর্বোচ্চ স্বীকৃতি। কিন্তু এই পথ ছিল কঠিন ও সংগ্রামময়। পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে সাম্প্রদায়িকতা ও সাম্রাজ্যবাদের উত্থানের মুখে তিনি হয়ে ওঠেন প্রতিবাদের প্রথম সারির কণ্ঠ। সামরিক সরকারের রোষানলে পড়ে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় তাঁকে জেল খাটতে হয়। ১৯৮৩ সালে স্বৈরাচার এরশাদের ক্যান্টনমেন্ট কারাগারে বন্দি থেকেও তিনি ছিলেন দৃঢ়, অটল ও আপসহীন।

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় ফরহাদের কারাগারের কক্ষটিই পরিণত হয়েছিল গণতান্ত্রিক শক্তির তীর্থস্থানে। ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে দুই প্রধান নেত্রীর মধ্যে ১৫০-১৫০ আসনের সমঝোতার ফর্মুলা তিনি দিয়েছিলেন—যা তৎকালীন শাসক এরশাদকে পর্যন্ত আইন পরিবর্তনে বাধ্য করে। জনগণের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ছিল আত্মিক; শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী কিংবা সাংবাদিক—সবাইকে তিনি যুক্ত করেছিলেন এক অভিন্ন লাল পতাকার ছায়ায়।

১৯৮৭ সালের ৯ অক্টোবর, সোভিয়েত ইউনিয়নের রাজধানী মস্কোয়, মাত্র ৪৯ বছর বয়সে হৃদরোগে তাঁর আকস্মিক মৃত্যু ঘটে। মাত্র চার বছর পর, ১৯৯১ সালে, পতন ঘটে সেই সোভিয়েত রাষ্ট্রের—যে রাষ্ট্র ছিল তাঁর বিপ্লবী আদর্শের অনুপ্রেরণা। তাঁর মৃত্যুর পর বিভক্ত হয়ে পড়ে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, হারায় ফরহাদের সেই ঐক্য ও শৃঙ্খলার শক্ত ভিত্তি।

আজকের বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে, যখন সমাজ জর্জরিত শোষণ, বৈষম্য, দুর্নীতি ও সাম্প্রদায়িকতার দংশনে, তখন কমরেড ফরহাদের জীবন ও চিন্তা আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। তাঁর উত্তরাধিকার শুধু একটি ঐতিহাসিক স্মৃতি নয়—এটি একটি বুদ্ধিদীপ্ত রাজনৈতিক ইশতেহার, যা আমাদের নতুন প্রজন্মকে জনগণের সার্বিক মুক্তির সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করে চলেছে।



বিষয়:


পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top