জিয়া হত্যাকাণ্ড ছিল পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র: চট্টগ্রামের তৎকালীন ডিসি জিয়াউদ্দিন এম চৌধুরী
চট্টগ্রাম | নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ৫ নভেম্বর ২০২৫, ১৫:৩৩
১৯৮১ সালের ৩০ মে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড ছিল একটি গভীর ষড়যন্ত্রের ফসল— এমন মন্তব্য করেছেন সেই সময় চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক (ডিসি) হিসেবে দায়িত্ব পালন করা জিয়াউদ্দিন এম চৌধুরী। তিনি বলেন, “এটি কোনো আকস্মিক ঘটনা নয়, বরং একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড।”
৪৪ বছর আগের সেই হৃদয়বিদারক ঘটনার স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, “প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ডের অনেক কিছুই এখনো অজানা। বিশেষ করে তার মরদেহ নিয়ে নানা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করেছিল ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। কিন্তু প্রকৃত ঘটনাটি কীভাবে ঘটেছিল, তা আমি নিজ চোখে দেখেছি।”
জিয়াউদ্দিন এম চৌধুরী জানান, ৩০ মে ভোরে সার্কিট হাউসে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, প্রেসিডেন্টের লাশ সেনারা নিয়ে গেছে, কিন্তু সেনানিবাসে নয়।
“রাঙ্গুনিয়া থানার পুলিশ জানায়, রাতে সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য প্রেসিডেন্টের মৃতদেহ একটি ট্রাকে করে বাংলাদেশ টোব্যাকো কোম্পানির কাছে একটি খালি জায়গায় নিয়ে যায়। সেখানে একজন মৌলবি অস্ত্রের মুখে জানাজা ও দাফনের কাজে সাহায্য করেন,” বলেন তিনি।
পরে খবর পেয়ে চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার লাশ উত্তোলনের নির্দেশ দেন। ডিসি জিয়াউদ্দিন জানান, “আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, প্রেসিডেন্টের লাশ চট্টগ্রাম শহরে আনা যাবে না— সরাসরি সেনানিবাসে নিতে হবে।”
এরপর তিনি, বিভাগীয় কমিশনার সাইফুদ্দিন ও পুলিশ সুপার মিলে রাঙ্গুনিয়া গিয়ে লাশ সেনানিবাসে নিয়ে আসেন। সেখানে ড্রেসিং শেষে লে. কর্নেল তোফায়েল লাশ দেখতে ডাকেন।
“মুখের এক পাশে কোনো মাংস ছিল না, গোঁফের অংশও ছিল না— এক হৃদয়বিদারক দৃশ্য,” বলেন তিনি।
ব্রিগেডিয়ার আজিজের তত্ত্বাবধানে সেনানিবাসে জানাজার আয়োজন হয়।
“সেনারা জিয়ার জানাজা ছাড়া লাশ ঢাকায় পাঠাতে রাজি ছিলেন না,” বলেন জিয়াউদ্দিন।
অবশেষে কফিন হেলিকপ্টারে তোলা হয়, সেনারা সারিবদ্ধ হয়ে দাঁড়ান, এবং মাওলানা জানাজা পড়ান। এরপর হেলিকপ্টার ঢাকার উদ্দেশে উড়ে যায়। বিকেলে চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে লাখো মানুষের উপস্থিতিতে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।
প্রেসিডেন্ট জিয়ার সঙ্গে সর্বশেষ দেখা হয়েছিল হত্যার আগের রাত ৯টার দিকে।
“তখন সার্কিট হাউসে আইনশৃঙ্খলা বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বিএনপির দুই গ্রুপের দ্বন্দ্ব মেটানোর বৈঠক দীর্ঘ হয়। আমরা রাত ৯টার পর চলে যাই। প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, সকালে কথা হবে,” বলেন জিয়াউদ্দিন।
তিনি জানান, সেই রাতে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছিল। “আমি ও স্ত্রী বাসায় ফিরি, ঘুমিয়ে পড়ি। সকালে প্রেসিডেন্টকে নিতে বিমানবন্দরে যাওয়ার কথা ছিল।”
জিয়াউদ্দিন জানান, প্রেসিডেন্ট জিয়া মে মাসের মাঝামাঝি কক্সবাজারে সেনা মহড়া দেখতে আসেন।
“দুই সপ্তাহের মধ্যেই তার আবার চট্টগ্রাম সফরে আসা আমাকে বিস্মিত করেছিল,” বলেন তিনি।
সাধারণত প্রেসিডেন্টের সফরের অন্তত এক মাস আগে ডিসিকে জানানো হয়। কিন্তু এ সফরের খবর আসে মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগে। প্রেসিডেন্ট চট্টগ্রামে আসেন বিএনপির দুই গ্রুপের অন্তর্দ্বন্দ্ব মেটাতে।
বিমানবন্দরে প্রেসিডেন্টকে স্বাগত জানাতে উপস্থিত ছিলেন বিভাগীয় কমিশনার, ডিআইজি, পুলিশ কমিশনার ও সামরিক কর্মকর্তারা।
“কিন্তু ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল মঞ্জুর উপস্থিত ছিলেন না— এটি খুব অস্বাভাবিক ছিল,” বলেন জিয়াউদ্দিন।
ব্রিগেডিয়ার আজিজ জানান, “মঞ্জুর টেনিস খেলতে গিয়ে ব্যথা পেয়েছেন।” তখন প্রেসিডেন্ট হেসে বলেছিলেন, ‘মঞ্জুরকে বলো, টেনিস একটু কম খেলতে।’
বিমানবন্দর থেকে সার্কিট হাউসে যাওয়ার পথে রাস্তার দিকে তাকিয়ে প্রেসিডেন্ট জিয়া বলেন, “মাঝখানের ডিভাইডার উঠিয়ে দিলে রাস্তা আরও প্রশস্ত হবে।”
ডিসি বলেছিলেন, এতে ট্রাফিকের শৃঙ্খলা নষ্ট হবে। উত্তরে প্রেসিডেন্ট বলেন, “বাঙালিদের মধ্যে শৃঙ্খলা আনার জন্য এটা দরকার। তারা রাস্তার এদিক-সেদিক চলতে পারবে না। বাঙালি এখনো শৃঙ্খলা শেখেনি।”
চট্টগ্রাম পৌঁছে প্রেসিডেন্ট প্রথমে চন্দনপুরা মসজিদে জুমার নামাজ আদায় করেন। এরপর সার্কিট হাউসে ফিরে দুপুরের খাবার শেষে শুরু হয় বিএনপি নেতাদের সঙ্গে বৈঠক।
“সেই বৈঠক আর শেষ হয়নি,” বলেন তৎকালীন ডিসি জিয়াউদ্দিন এম চৌধুরী।
রাতেই ঘটে ইতিহাসের এক হৃদয়বিদারক ঘটনা— প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের হত্যাকাণ্ড।
বিষয়:

পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।