দুই বছরের আগ্রাসনে ধ্বংস ৮৩৫টি মসজিদ, তবুও থামেনি আজানের ধ্বনি
আন্তর্জাতিক ডেস্ক | প্রকাশিত: ১১ অক্টোবর ২০২৫, ১৭:৩৬

গাজা উপত্যকার আকাশে আজও ধুলো উড়ছে ধ্বংসস্তূপ থেকে।দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে চলা ইসরায়েলি আগ্রাসনে এই উপত্যকার প্রায় সব অবকাঠামো ভস্মীভূত হয়ে গেছে।
বোমার আঘাতে নিশ্চিহ্ন হয়েছে স্কুল, হাসপাতাল, বাজার— এমনকি মসজিদও।
যেসব মিনার একসময় মানুষকে নামাজের ডাক দিত, সেগুলো এখন পাথর ও ধুলার স্তূপে পরিণত।
গাজা শহরের শুজাইয়্যা পাড়ার উপকণ্ঠে ৬২ বছর বয়সী আবু খালেদ আল-নাজ্জার দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর শৈশবের ইবনে ওসমান মসজিদের ধ্বংসাবশেষের সামনে।
চোখ ভেজা কণ্ঠে তিনি বলেন,
“আমার বাবার কণ্ঠস্বর বোঝার আগে আমি মুয়াজ্জিনের কণ্ঠস্বর চিনতাম। আমি পঞ্চাশ বছর ধরে এখানে নামাজ পড়েছি… আজ দরজার পাশে থাকা নামাজের গালিচাটিও ধ্বংসস্তূপের নিচে উধাও। আমি কখনো ভাবিনি, এমন দিন আসবে, যখন আমরা মসজিদ ছাড়া নামাজ পড়ব।”
গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস জানিয়েছে,
গত দুই বছরে ইসরায়েলি বাহিনী উপত্যকাজুড়ে মোট ১,২৪৪টি মসজিদের মধ্যে ৮৩৫টি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করেছে এবং ১৮০টি আংশিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত।
এগুলোর মধ্যে মামলুক ও অটোমান আমলের বেশ কিছু মসজিদও রয়েছে— যেগুলোর ইতিহাস সাত শতাব্দীরও পুরোনো।
পুরাতন শহরের গ্রেট ওমারি মসজিদের ধ্বংসস্তূপে ২৭ বছর বয়সী মাহমুদ কান্দিল পাথর খুঁজছেন—
কিবলা দেয়াল থেকে খোদাই করা কোনো অংশ হয়তো টিকে আছে এই আশায়।
তিনি বলেন,
“এই মসজিদ ছিল গাজার প্রাণকেন্দ্র। এখানেই আমি আমার প্রথম শুক্রবারের নামাজ পড়েছিলাম। মামলুক যুগের মার্বেল স্তম্ভগুলো এখন ধুলোতে মিশে গেছে। মনে হচ্ছে তারা কেবল ভবন নয়, শহরের স্মৃতিও মুছে ফেলতে চায়।”
আল-দারাজ পাড়ায় একসময় আল-সাইয়্যিদ হাশিম মসজিদ ছিল।
এখন সেখানে কেবল ধ্বংসস্তূপ আর ধূলো।
৭৪ বছর বয়সী উম্মে ওয়ায়েল একটি প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে তাকিয়ে আছেন ভাঙা গম্বুজের দিকে।
তিনি বললেন,
“আমি অসুস্থ থাকলেও প্রতি বৃহস্পতিবার সূরা আল-কাহফ পড়তে যেতাম। এখন কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। তবুও আমরা আমাদের ঘরে বসে কুরআন পড়ব— আল্লাহ আমাদের কথা শোনেন।”
খান ইউনিসের বাসিন্দা ৪৫ বছর বয়সী আবদুর রহমান আল-সাত্রি বলেন,
“মসজিদটি আমাদের একত্র করত, শুধু নামাজের জন্য নয়— বিবাহ, জানাজা, কুরআন পাঠ, লাইব্রেরি— সবই ছিল। তারা সবকিছু ধ্বংস করে দিয়েছে, যেন আমরা আত্মা ছাড়া বাঁচি।”
ইসলামিক ইতিহাস গবেষক মোহাম্মদ জুহা বলেন,
গাজার ওপর এই আগ্রাসন শুধুমাত্র স্থাপত্য ধ্বংস নয়— এটি ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ওপর ইচ্ছাকৃত আঘাত।
“মিনারগুলো ছিল শহরের ল্যান্ডমার্ক। এখন মানুষের স্মৃতিতে কেবল নামগুলোই রয়ে গেছে।”
সবকিছু হারিয়েও গাজার আকাশে আজানের ধ্বনি এখনো শোনা যায়।
ধ্বংসস্তূপের উপর উঠে তরুণেরা ব্যাটারিচালিত লাউডস্পিকার হাতে আজান দিচ্ছে।
ভাঙা দেয়ালের কোণে পুরোনো মাদুর বিছিয়ে মানুষ নামাজে দাঁড়াচ্ছে।
কারণ তারা জানে— মসজিদ ভাঙা যেতে পারে, কিন্তু ঈমান ভাঙে না।
বিষয়:
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।