বুধবার, ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৭ পৌষ ১৪৩২

রাজনীতির আড়ালের এক নীরব মানবিক ইতিহাস

ছায়াসঙ্গী ফাতেমাকে চিরবিদায় জানালেন খালেদা জিয়া

নিউজফ্ল্যাশ ডেস্ক | প্রকাশিত: ৩১ ডিসেম্বর ২০২৫, ১২:২৫

ছবি: সংগৃহীত

সেই ছায়াসঙ্গী গৃহকর্মী ফাতেমা বেগমকে চিরবিদায় জানালেন বিএনপির চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। এভারকেয়ার হাসপাতালে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত খালেদা জিয়ার পাশে ছিলেন ফাতেমা। রাজনীতির উত্তাল সময়ে, কারাগার থেকে হাসপাতাল—সবখানেই ছিলেন তিনি নীরব সঙ্গী হয়ে।

এক সময় ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কটাক্ষ করে বলেছিলেন, কারাগারেও তাকে (খালেদা জিয়া) ফাতেমাকে লাগবে। সেই কথাই যেন বাস্তবে প্রমাণ হয়ে উঠেছিল।

রাজনীতির ইতিহাসে উচ্চারিত হয় নেতা, আন্দোলন, ক্ষমতা আর কারাবাসের নাম। কিন্তু সেই ইতিহাসের আড়ালে থেকে যায় কিছু নীরব মুখ—যারা আলোয় নয়, ছায়ায় থেকেই ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকেন। বেগম খালেদা জিয়ার জীবনে তেমনই এক ছায়াসঙ্গীর নাম ফাতেমা বেগম।

দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে গৃহকর্মীর পরিচয় পেরিয়ে ফাতেমা হয়ে উঠেছিলেন খালেদা জিয়ার একান্ত সঙ্গী। কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠ, গৃহবন্দিত্বের দীর্ঘ দিন, হাসপাতালের নিঃসঙ্গ রাত কিংবা বিদেশ সফরের নীরব করিডর—সবখানেই নিঃশব্দে উপস্থিত ছিলেন তিনি।

তিনি কোনো রাজনৈতিক কর্মী নন, নেই কোনো দলীয় পরিচয়। তবু ইতিহাসের কঠিন সময়গুলোয় তার উপস্থিতি ছিল অবিচ্ছেদ্য।

ফাতেমার জন্ম ভোলা সদর উপজেলার কাচিয়া ইউনিয়নের শাহ-মাদার গ্রামে। রফিকুল ইসলাম ও মালেকা বেগম দম্পতির পাঁচ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। অল্প বয়সেই সংসারের দায়িত্ব এসে পড়ে তার কাঁধে।

একই ইউনিয়নের কৃষক মো. হারুন লাহাড়ির সঙ্গে বিয়ের পর মেঘনা নদীর চরে কৃষিকাজ করে চলছিল সংসার। তাদের ঘরে জন্ম নেয় মেয়ে জাকিয়া ইসলাম রিয়া ও ছেলে মো. রিফাত। কিন্তু ২০০৮ সালে, ছেলের বয়স যখন মাত্র দুই বছর, তখন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মারা যান তার স্বামী। এক মুহূর্তে বদলে যায় জীবনের সব হিসাব।

স্বামীর মৃত্যুর পর দুই সন্তানকে নিয়ে তিনি ফিরে যান বাবা-মায়ের ঘরে। কিন্তু মুদি দোকানি বাবার সামান্য আয় সংসার চালাতে যথেষ্ট ছিল না। তখন কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে সন্তানদের গ্রামে রেখে কাজের সন্ধানে ঢাকায় পাড়ি জমান ফাতেমা।

২০০৯ সালে পূর্বপরিচিত এক ব্যক্তির মাধ্যমে তিনি কাজ পান খালেদা জিয়ার বাসভবনে। সেখান থেকেই শুরু হয় এক দীর্ঘ সহযাত্রা। রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে থাকা এক নেত্রীর দৈনন্দিন জীবনের নীরব সাক্ষী হয়ে ওঠেন ফাতেমা।

বাথরুমে নেওয়া-আনা, ওষুধ খাওয়ানো, শারীরিক দুর্বলতায় হাত ধরে রাখা—এসব কাজ তার কাছে ছিল শুধু দায়িত্ব নয়, বরং এক গভীর মানবিক সম্পর্কের দায়।

২০১৪ সালের ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচির সময় গুলশানের ফিরোজার সামনে বালুভর্তি ট্রাক দিয়ে পথ রুদ্ধ করে দেয় পুলিশ। গাড়িতে উঠেও বের হতে না পেরে ফিরোজার দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছিলেন খালেদা জিয়া।

পুলিশি চাপে শরীরের ভার সামলাতে পারছিলেন না তিনি। ঠিক তখনই দৃশ্যপটে আসেন ফাতেমা—নীরবে শক্ত করে ধরে রাখেন খালেদা জিয়ার হাত। ক্যামেরার ফ্রেমে ধরা পড়ে সেই মানবিক দৃশ্য, যা রাজনীতির উত্তাপের মাঝেও এক স্থির মানবিক ছবি হয়ে থাকে।

২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি। আদালতের রায়ে খালেদা জিয়া যান নাজিমুদ্দিন রোডের পুরোনো কেন্দ্রীয় কারাগারে। তার আইনজীবীরা আবেদন করেন, গৃহকর্মী ফাতেমা বেগম যেন তার সঙ্গে থাকতে পারেন।

আদালতের অনুমতিতে ছয় দিন পর কারাগারে প্রবেশ করেন ফাতেমা। কোনো রাজনৈতিক পরিচয় ছাড়াই তিনি হয়ে ওঠেন স্বেচ্ছা কারাবন্দি। কারণ, তিনি জানতেন—এই সময়ে একা থাকা মানেই ভেঙে পড়া।

২০২১ সালের এপ্রিল মাসে করোনা আক্রান্ত হন খালেদা জিয়া। টানা ৫৩ দিন হাসপাতালে ছিলেন তিনি। যখন মানুষ প্রিয়জনের কাছেও যেতে ভয় পাচ্ছিল, তখন ফাতেমা ছিলেন অবিচল। সেবিকা হয়ে, সাহস হয়ে, ছায়া হয়ে তিনি ছিলেন তার পাশে।

সর্বশেষ লন্ডনে উন্নত চিকিৎসার সময়ও খালেদা জিয়ার সঙ্গে ছিলেন ফাতেমা। আগেও একাধিকবার বিদেশ সফরে তার সঙ্গী হয়েছেন তিনি। কোনো আলোচনায় নেই তার নাম, নেই কোনো বক্তব্য। তবু ইতিহাসের পাশে পাশে তার ছায়া পড়ে আছে।

ফাতেমা বেগম প্রমাণ করেছেন—সব সম্পর্ক ক্ষমতার নয়। কিছু সম্পর্ক গড়ে ওঠে দায়িত্ব, মমতা আর নিখাদ মানবিকতা দিয়ে। রাজনীতির কোলাহলের ভিড়ে তিনি এক নীরব নাম, আর সেই নীরবতাই তাকে আলাদা করে চিহ্নিত করে।



বিষয়:


পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top