• ** জাতীয় ** আমরা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস করেছি : শেখ হাসিনা ** আবারও তিন দিনের ‘হিট অ্যালার্ট’ জারি ** চুয়াডাঙ্গায় হিট স্ট্রোকে দুই নারীর মৃত্যু ** ইউআইইউ ক্যাম্পাসে ‘কৃত্রিম বৃষ্টি’ নিয়ে তোলপাড় সারাদেশ ** সিলেটে মসজিদে যাওয়ার পথে বজ্রপাতে ইমামের মৃত্যু ** নরসিংদীতে হিট স্ট্রোকে যুবকের মৃত্যু ** সব ধরনের সংবাদ জানতে ভিজিট করুন : https://www.newsflash71.com ** সব ধরনের ভিডিও দেখতে ভিজিট করুন : youtube.com/newsflash71 ** লাইক দিন নিউজফ্ল্যাশের ফেসবুক পেইজে : fb/newsflash71bd **


সাংবাদিক অহিদুল ইসলামের ফেসবুক পাতা থেকে

নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ২৯ ডিসেম্বর ২০২০, ২৩:৫৩

ছবি: অহিদুল ইসলাম

অনুভূতির দেশ:

বাংলাদেশ একটি ভয়ংকর অনুভূতিতে আক্রান্ত দেশে পরিনত হয়েছে। যে কোনো ব্যপারেই অনুভূতি প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের মতো আঘাত করছে দেশের মানুষের উপর। ধর্মীয় অনুভূতি ব্যপক মাত্রায় সর্বদা জাগ্রত এটা সবাই এখন মেনেই নিয়েছে। তবে সেটা শুধু মাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সম্প্রদায় ও ইসলাম ধর্মের জন্যই জাগ্রত থাকে।

অন্য ধর্ম, ধর্ম বিশ্বাস নিয়ে ওয়াজ মাহফিল করে কটাক্ষ করা হয় প্রতিনিয়ত। তাদের পূজার মূর্তি ভেঙ্গে ফেলার ঘটনা দেখি পত্রিকায়। এতে সংখ্যালঘুদের অনুভূতিতে আঘাত লাগলেও সেটাকে বাংলাদেশে অপরাধের মধ্যে ধরা হয় বলে মনে হয় না। কারণ সেই অপরাধে কাউকে গ্রেফতার ও বিচারের মুখোমুখি হতে দেখি না।

এই দেশে এখন ফেসবুকের স্ট্যাটাস, বাউলের গান, খেলোয়ারের পূজামন্ডপ দর্শন, সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্রের নাম, সিনেমার ডায়লগসহ এমন নানা বিষয়ে মানুষের অনুভূতি আঘাত প্রাপ্ত হয়।

এমনকি একজন নারী গাইনী চিকিৎসক নরসুন্দরকে বিয়ে করায় একজন পুলিশ কর্মকর্তার অনুভূতি আঘাত প্রাপ্ত হয়। আইনে ব্যবস্থা নেয়ার তেমন সুযোগ না থাকায় মিডিয়া হাজির করে তাদের হেনস্তা করা হয়।

এর বাইরে অন্যদেরে আইন দিয়ে কিংবা আইনে বাইরে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করে ছেচা মাইর দেয়া হয়। ছেচা মাইর হলো সেই মাইর যাতে আঘাত আছে, ব্যথা আছে কিন্তু কোনো চিহ্ন নাই। ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের মতো কেউ কেউ ফেসবুকে মাফ চেয়ে পার পায়, অন্যরা তাও পায় না।

সিনেমাতে একজন পরিচালক থাকেন; তিনিই চূড়ান্তভাবে ঠিক করেন ডায়ালগটা কি হবে, কিভাবে বলতে হবে, কেমন হবে; যেহেতু পর্ণমুভি না; তাই তেমন একটি সিনেমাতে ডায়লগ বলার জন্য; অভিনয়ের জন্য একজন অভিনেতাকে দায়ী করে কিভাবে জেলে পাঠানো গেলো সেটাই আমার মাথায় ঢুকছে না? সিনেমাতে অভিনয় করা নায়িকা স্পর্শিয়াকেও খুঁজতেছে পুলিশ। কিন্তু কেনো?

বলছিলাম নবাব এল.এল.বি. সিনেমার কথা। সিনেমার গল্পে একজন মেয়ে ধর্ষিত হয়; থানায় পুলিশের কাছে মামলা করতে গিয়েছে। সেখানে পুলিশ ধর্ষণনের শিকার নারী কাছে ঘটনার বর্ণনা জানতে চেয়েছেন।

পুলিশের চরিত্রে অভিনয় করা অভিনেতা কিছু প্রশ্ন করেন;

ধর্ষক উপরে না নিচে ছিলো?

ধর্ষক বীর্যপাত করেছে কিনা?

ভেতরে না বাইরে?

বিয়ে হয়েছে কিনা?

বিয়ে হয় নাই, কিন্তু বিয়ের আগে যৌন সংঙ্গমের অভিজ্ঞতাে আছে কিনা?

সব শেষ পিরিয়ড কবে হয়েছিলো?

মামলার জন্য তথ্যগুলো প্রয়োজন তাই এসব প্রশ্ন করেছে পুলিশ। এতেই নাকি পুলিশকে হেয় করে উপস্থাপন করা হয়েছে। পুলিশের অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে। সম্মানহানি হয়েছে; তাই পর্ণ্যগ্রাফি প্রতিরোধ আইনে মামলা করা হয়।পরিচালক অনন্য মামুন ও অভিনেতা শাহীন মৃধাকে বৃহস্পতিবার (২৪ ডিসেম্বর, ২০২০) মধ্য রাতে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ মিরপুর এলাকা থেকে তাদের গ্রেফতার করে।

খুব ভালো কথা। অাইনের শাসন অবশ্যই জারি রাখতে হবে। এবার একটু পেছনে ফিরে যাই; চলে যাই ফেনী জেলার সোনাগাজিতে; সেখানে নুসরাত নামের মাদ্রাসা ছাত্রীর শ্লীলতাহানি ও হত্যাকান্ডের ঘটনায় ওসি মোয়াজ্জেমের ৮ বছরের কারাদন্ড ও ১০ লাখ টাকা জরিমানা হয়েছে৷ ওসি সাহেব কিন্তু নুসরাতের সাথে ঘটা ঘটনার সরাসরি অংশ নেন নি। প্রথম অালো পত্রিকার খবরে বলা হয়েছে, থানায় গেলে "ওসি মোয়াজ্জেম হোসেন সে সময় নুসরাতকে আপত্তিকর প্রশ্ন করে বিব্রত করেন এবং তা ভিডিও করে অনলাইনে ছড়িয়ে দেন";

ওই ভিডিওতে আমরা দেখি নুসরাত বলে আমার গায়ে হাত দিয়েছে স্যার; ওসি সাহেব জানতে চান কোথায় হাত দিয়েছে? তারপর কি হলো?

কান্নায় ভেঙ্গে পরে নুসরাত বলে এই ভিডিও ছড়িয়ে পরলে তারই সম্মান নষ্ট হয়ে যাবে, ওসি সাহবে "আপত্তিকর" প্রশ্ন করে শুধু খান্ত হন নাই, চেহারা যেনো দেখা যায় সেজন্য হাত দিয়ে ঢেকে রাখা মুখটি বারবার বের করতে বলেন নুসরাতকে। সেটা যে অপরাধ ছিলো আদালতও সেই রায় দিয়েছে। তাহলে এমন একটি গল্প সিনেমার মাধ্যমে তুলে ধরলে অপরাধটা কোথায়? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অনেকে মন্তব্য করেছে পুলিশের আসল চরিত্র তোলে ধরা হয়েছে, তাই পুলিশের শরীরে ফোস্কা পরেছে।

কিন্তু সিনেমার জন্য কেনো মামলা সমিচীন না, তার একটু ব্যাখ্যা করি; সিনেমার শুরুতে একটা ঘোষণা থাকে যেখানে বলা হয় সিনেমার ঘটনা, চরিত্র ও ডায়লগ সব কাল্পনিক; এটাতো সিনেমা। বাস্তব না। এটা মানুষ উপভোগ করবে। সিনেমা দেখে তো কেউ স্থির সিধান্তে পৌচ্ছায় না; যেহেতু নবাব এল এল বি সিনেমাটি বাস্তব ঘটনা অবলম্বনে তৈরী হয়নি। তাই পুরোটাই কাল্পনিক। পুলিশ কেনো এই মজাটুকুও নিতে পারলো না? কারণ বাস্তব জগতে অনেক পুলিশ ও আইন শৃংঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে এরচেয়েও গুরুত্বর অভিযোগ আছে, অভিযোগ প্রমানিত হয়েছে, শাস্তি হয়েছে। ওসি মোয়াজ্জেম তার একটি উদাহরণ মাত্র।

প্রথম আলো পত্রিকায় এই অভিনেতা ও পরিচালক গ্রেফতারের খবর দিয়েছে; তার ঠিক নিচেই অারেকটি খবর; টাকা ছিনতাই এর অভিযোগে দুই পুলিশ সদস্যে গ্রেফতার করা হয়েছে। এমন শিরোনাম আছে। এটাই হলো দেশের বাস্তবতা; সমাজের অন্য সব পেশার মানুষের মতোই কিছু পুলিশও অপকর্ম করে, কেউ কেউ ধরাও পরে। তাদের সাজা হয়। অনেকে হয়ত ধরা পরে না; সাজা হয় না৷

ন'ডরাই নামে আরেকটি সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্রের নাম আয়েশা। যিনি সমাজ ও পরিবারের নানা বাঁধা পেরিয়ে উত্তাল সমুদ্রের ঢেউয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সাার্ফিং করে। নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) স্ত্রীর নাম ছিলো আয়শা; তাই একজন আইনজীবী সিনেমাটির পরিচালকে উকিল নোটিশ পাঠায়। আর ওই আইনজীবী সুরে সুর মিলিয়ে অনেকেই ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত লাগে বলে ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মত প্রকাশ করে। উকিল সাহেব সিনেমাটি বন্ধ করে দিতে চায়। বাস্তব জীবনে যারা আয়শা, খাদিজা, আমেন, কুলসুম, ফাতেমা.... মানে নবীর স্ত্রী বা সন্তান বা আত্মীয়দের নামে মিল থাকা নারীদের বিয়ে করেছে উকিল নোটিশের কথা শুনে তারা টাসকি খেয়ে পরে ছিলো।

হেফাজত ইসলাম অনেকগুলো আবদার সরকারের কাছে জমা দিয়েছিলো। তাঁর মধ্যে একটি ছিলো চলচ্চিত্রে দাঁড়ি টুপি পরিহিত ব্যক্তিদের খল চরিত্রের মানুষ হিসেবে দেখানো হয়, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক চলচ্চিত্রে দাঁড়ি টুপি পরিহতদের স্বাধীনতা বিরোধী খারাপ মানুষ হিসেবে দেখানো হয়। এটা দেখানো যাবে না। এতে ধর্মের অবমাননা করা হয়। দাঁড়ি টুপিকে অসম্মান করা হয়। চলচ্চিত্রে সমাজের প্রতিচ্ছবি; এক ধরণের মুক্ত মত ও চিন্তা প্রকাশের জায়গা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে রাজাকারের শিরোমনিরা সবাই দাঁড়ি টুপি পরে ইসলামের নাম নিয়েই অপকর্ম করেছে। তাদেরকে দেখাবে না? ফেনীর নুসরাতের শ্লীলতাহানি ও হত্যাকান্ডে জড়িত অধ্যক্ষ সিরাজ তো দাঁড়ি টুপি পরাই ছিলো; তারপরও সে রেহায় দেয়নি; রেহাই পায়নি পর্দা করা নুসরাতও।

পুলিশ বলছে তাদের খারাপ হিসেবে দেখানো হচ্ছে এমন সিনেমা করা যাবে না, হেফাজত বলছে হুজুরদের খারাপ হিসেবে দেখানো হয় এমন সিনেমা করা যাবে না, রাজনীতিবিদদের খল চরিত্রে দেখানো হয় এটা করা যাবে না, সরকারী আমলাদের দুর্ণীতিবাজ হিসেবে দেখানো যাবে না; সাংবাদিকদের হলুদ সাংবাদিক হিসেবে দেখানো যাবে না; সবার এমন আবদার রক্ষা করলে তো সিনেমা বানানোই যাবে না। সিনেমা কে কেনো আমরা আনন্দ দেয়ার খোরাক হিসেবে দেখতে পারি না। এটাই আমার প্রশ্ন!

আগে তো এসব বিষয় সামনে আসতো না। এখন আসছে। এর কারণ কি আমাদের মাথাপিছু আয়, শিক্ষার হার, রির্জাভ ও আর্থিক উন্নতির পাশাপাশি অনুভূতিরও উন্নতি হয়েছে। এতোই বেড়েছে যে পান থেকে চুন না খসলেও সম্মান খসে যাচ্ছে। অনুভূতিতে আঘাত লাগছে?

এর আগে হূমায়ুন আহমেদের লিখা 'হলুদ হিমু কালো RAB' বই নিয়ে আপত্তি তুলেছিলো পুলিশ।হূমায়ুন আহমেদের অসীম জনপ্রিয়তার কারণে সেই আপত্তি ধোপে টেকেনি। তবে নানা ঘটনার পর এখন প্রকাশের আগে বই পুলিশ পড়ে দেখছে; আপত্তিকর কিছু থাকলে তা প্রকাশই করতে দিচ্ছে না।

এবার সংবিধানে দিকে একটু তাকাই; আমাদের সংবিধানের তৃতীয় ভাগে 'চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হয়েছে', এবং এটি সব মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ' প্রত্যেক নাগরিকের বাক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার এর নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে৷

তবে এই স্বাধীনতা সব বিষয়ে উপভোগের করা যাবে না। ৩৯ এর ২ ধারায় বলা হয়েছে রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, বিদেশী রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্ক, জনশৃংঙ্খলা, শালীনতা ও নৈতিকতার স্বার্থে, আদালত অবমাননা, মানহানি বা অপরাধ সংগঠনের প্ররোচনা আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাঁধা নিষেধ সাপেক্ষে চিন্তা বিবেক ও ভাব প্রকাশের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে।

সিনেমা বা অনলাইনে৷ যে কোনো বিষয়কে চাইলে নিরাপত্তা, শালীনতা ও নৈতিকতার মধ্যে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে ফেলে দিতে পারবেন। ওই যে দূর্বল ছাত্রের গরুর রচনা লিখার মতো। এক ছাত্র পড়ে গেছে গরুর রচনা। পরীক্ষায় এলো নদী রচনা। সে শুরু করলো, গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে নদী। নদীর পাড়ে একটি গরু বাঁধা ছিলো, সেই গরুর চারটি পা, দুইটি চোখ, দুইটি কান, আর লম্বা লেজ আছে, লেজের মাথায় চুল আছে, লেজ দিয়ে গরু মাছি তাড়ায়..... আমার মনে হয় পুলিশও আর কিছু না পেয়ে দূর্বল ছাত্রের মতো ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে পর্ণ্যগ্রাফি আইনের মধ্যে ফেলে দিয়েছে৷

সব সিনেমাকেই আপনি শালীনতার সীমা লঙ্ঘণ করেছে এমন ধারার মধ্যে ফেলে দিতে পারেন। 'শালীনতা' 'আপত্তিকর' 'মানহানি' এই শব্দগুলোর মাপকাঠি কি? একজন আলেম মিজানু রহমান আজহারী কাছে কাছে শালীনতার সংজ্ঞা হবে "পায়ের পাতার পর এক হাত লম্বা কাপড়, ধুলাবালিসহ টানতে হবে নারীকে"; তাহলেই সেটা শালীন পোশাক হবে। আবার অভিনেত্রী সানাই এর কাছে সেই সংজ্ঞায় থাই পর্যন্ত ফাঁকা থাকলেও সেট শালীন পোশাক। তাই এসব বিষয়ে সীমা টানা দুস্কর ব্যপার। তবে সমাধান কি; সেটা পরি লিখছি আমার সীমিত জ্ঞানে।

গান গাওয়ার কারণে বাউল শিল্পী শরিয়ত বয়াতি ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কারাগারে আছেন। নারী বাউল শিল্পী রিতা দেওয়ান জেলে যাওয়ার অপেক্ষায় আছেন। তাঁর বিরুদ্ধে করা মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন বা পিবিআই। ২০২০ সালের ২ ডিসেম্বর গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করেছে আদালত। এদের দুই জনের বিরুদ্ধেই গান গেয়ে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে তথ্য প্রযুক্তি আইনে মামলা হয়েছিলো।

আপাতত দৃষ্টিতে সব কিছুই আইনের মধ্যে থেকেই হচ্ছে। পুলিশও আইন অনুযায়ী তদন্ত করে ব্যবস্থা নিয়েছে।
আমরা অনেকেই ছোট বেলা থেকেই বাউল গান, পাল্লা-পাল্লী গান শুনে বড় হয়েছি। গ্রামে অনেকে ঈশার নামাজ আদায় করে গান শুনতে যেতো, ফজর নাম আদায় করে বাড়ি ফিরতো। পাল্লা পাল্লী গান হলো, যুক্তি পাল্টা যুক্তির বিষয়।
উপস্থিতভাবে গান বেঁধে সুর করে হাশর-কেয়ামত, আল্লাহ-নবী, নবী-বড় পীর আব্দুর কাদের জিলানী এমন নানান বিষয়ে আলোচনা, যুক্তি পাল্টা যুক্তি হতো, সবই তাৎক্ষনিক। এসব গানের বা কথার লিখিত রুপও থাকতো না।

এখন ইউটিউবের কল্যাণে ভিন্ন জায়গায় বসে কোনো একনজনের গান দেখে, তখন তাদের ভেতরে ধর্মীয় উত্তেজনা তৈরী হয়। এই সংকটের সমাধান কি আমি বুঝে ওঠতে পারি না। তবে গানের বিষয় বস্তু যাই থাকুক; যখন একজন বাউলকে গ্রেফতার করা হয়; আমার 'হীরক রাজার দেশে' সিনেমার কথা মনে পরে। যেখানে গান গাওয়ার অপরাধে বাউকে নিক্ষিপ্ত করা হয় জেলে।

আমার তো মনে হয় একটি যন্তর মন্তর ঘর থাকা দরকার৷ কারাগারে না পাঠিয়ে বরং তাদের ব্রেণ ওয়াশ করে অানা দরকার ওই ঘর থেকে। কারণ এই শিল্পীরা এসব গান আজকে নতুন করে গাইছেন না। দশকের পর দশক ধরে গেয়ে আসছেন। কিন্তু অনুভূতির আঘাতের নামে আইনের কপিকলের মারপ্যাঁচে পরছেন ইদানিং।

অামি বলবো বাংলাদেশের সিনেমা, নাটক, শিল্প, সাহিত্যের জন্য এগুলো চরম আঘাত। এভাবে চলতে থাকলে মানুষ স্থির, জড়বুদ্ধি হয়ে পড়বে। ভিন্ন মত ও পথের নুন্যতম জায়গাটাও আটকে যাচ্ছে।

আবার আসি নবাব এলএলবি সিনেমাতে;

সব পুলিশের যদি সম্মানের এতোই বালাই থাকতো তাহলে কখনোই কোনো পুলিশ টাকা ছিনতাই এর অভিযোগে গ্রেফতার হতো না। ওসি মোয়াজ্জেম নুসরাতের ভিডিও ভাইরাল করতো না। কেউ কেউ অপরাধ করে, এগুলো ব্যাক্তির অপরাধ হিসেবেই দেখতে হয়, পুরো বাহিনীকে এজন্য দায় দেয়া যায় না।

তবে কারো কারো আচরণ আমাদের হতবাক করে। এদের একজন; রংপুর সিআইডির এসপি মিলু মিয়া বিশ্বাস। প্রাপ্তবয়স্ক এক নারী চিকিৎসক বিয়ে করেছে নাপিতকে। এটিই তিনি মানতে পারনি। এক প্রাপ্তবয়স্ক নারী চিকিৎসক ভালোবেসে বিয়ে করেছেন। তদন্তে নেমে সেটি জানতেও পেরেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ-সিআইডি। তবুও ওই চিকিৎসক ও তার স্বামীকে ধরে এনে গণমাধ্যমের সামনে হাজির করে ‘আপত্তিকর’ বক্তব্য দিয়েছে তারা। সাংবাদিক ডেকে ছবিও তোলা হয়েছে।

তাদের চরম আপমান করা হয়েছে। তাদের শিশু সন্তানটিকেও মিডিয়াতে আনা হয়েছে, যেটা শিশু আইনের লঙ্ঘণ। আমাদের সংবিধান সব মানুষকে সমানাধিকার দিয়েছে। প্রাপ্ত বয়স্ক নারী পুরুষ তাদের পছন্দ সই বিয়ে করতে পারে। বাংলাদেশের আইন এসপিকে তো নয়ই; বাবা-মাকেও এই অধিকার দেয় নাই। সব জেনে বুঝে চিকিৎসক নারীর স্বামীকে অপহরণকারী হিসেবে কারাগারে পাঠিয়েছে। এখানে ওই পুলিশ কর্তা গ্র্যমো মোড়ল অথবা জমিদার সুলভ আচরণ করেছে বলে সামাজিক মাধ্যমে অনেকে মত প্রকাশ করেছে।

লিখাটা শেষ করবো আরেকটা উদাহরণ দিয়ে; কিছু দিন আগে বদি মারা গেলো। মানে অভিনেতা আব্দুল কাদের। কোথাও কেউ নেই নাটকে দেখানো হয়েছে, বদির মিথ্যা স্বাক্ষীতে বাকের ভাই এর ফাঁসি হয়৷ আরেকভাবে চিন্তা করলে এখানে আদালত ও বিচার ব্যবস্থাকে কটাক্ষ করা হয়েছে; হেয় করা হয়েছে; ন্যায় বিচারের জায়গা না আদালত এমন দেখানো হয়েছে বলা যেতেই পারে। তাহলে এমন কালজয়ী নাটক আমরা দেখতেই পারতাম না।

শিল্প সাহিত্যের সবগুলো শাখার বিকাশ হয় মুক্ত চিন্তা ও স্বাধীনতার মাধ্যমে। কোনো শিল্পী যদি স্বাধীনতার অপব্যবহার করে; স্বাধীনতাকে কুলষিত করে; তাহলে ওই শিল্পীর নিজের কর্ম টিকে থাকবে না; কখনোই থাকেনি। শিল্পী ও তাঁর শিল্প কোনোটাই কেউ মনে রাখবে না। এটাই শিল্প সাহিত্যে মুক্ত চিন্তা ও স্বাধীনতার নিয়ম। এ নিয়ে কোনো আইন কানুন দেখানোর দরকার দেখি না। দুনিয়াতে বহু মানুষ স্বাধীনভাবে তাদের চিন্তার কথা বলতে গিয়ে খুনের শিকার হয়েছে; সক্রেটিস তাদের একজন। তিনি জীবন হারিয়েছেন কিন্তু তাঁর চিন্তা কখনোই হারাবে না। অার যারা বিবেকের স্বাধীনতার অপব্যবহার করেছে আমরা তাদের কথা জানি না। তাই নাম জানানো গেলো না।

লেখক:

অহিদুল ইসলাম

সিনিয়র রিপোর্টার, একাত্তর টেলিভিশন

[email protected]

এনএফ৭১/আরআর/২০২০




পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top