বুধবার, ৪ জুন ২০২৫, ২১ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

বাজেট কী, বাজেট দেওয়ার দরকারটাই বা কী?

নিজস্ব প্রতিবেদক | প্রকাশিত: ২ জুন ২০২৫, ১৭:২২

ছবি: সংগৃহীত

বাজেট কথাটির সঙ্গে কম-বেশি আমরা পরিচিত। কিন্তু বাজেট কী বা কত প্রকার, সেটা সম্পর্কে অনেকেই খুব বেশি জানি না। এক কথায় বললে, বাজেট হচ্ছে একটি দেশের এক বছরের সম্ভাব্য সব আয়-ব্যয়ের বিস্তারিত হিসাব-নিকাশের বিবরণী। একটি নির্দিষ্ট সময়কালের জন্য সরকারের সম্ভাব্য ব্যয় এবং রাজস্বসহ অন্যান্য আয়ের একটি পূর্বাভাসও বলা যায় একে।

সরল ভাষায়, বাজেট মানে হলো—সরকার এক বছরে কত টাকা আয় করতে চায়, আর সেই টাকা কোন কোন খাতে খরচ করবে—তার লিখিত পরিকল্পনা। এটি শুধু আয়-ব্যয়ের খসড়া নয়, বরং একটি দেশের আর্থিক দিকনির্দেশনাও। কোনো নির্দিষ্ট আর্থিক বছরে সরকার বিভিন্ন উৎস থেকে কতটুকু আয় প্রাপ্তির আশা করে এবং বিভিন্ন খাতে কী পরিমাণ ব্যয় করতে চায়, তার সুবিন্যস্ত হিসাবকে সরকারি বাজেট বলে।

বাংলাদেশ সরকারের একটি বাজেটের সময়কাল হচ্ছে এক অর্থবছর, যা ১ জুলাই থেকে পরবর্তী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ধরা হয়। মূলত সরকারের এ নির্দিষ্ট সময়ে দেশের আর্থিক পরিকল্পনার সুষ্ঠু প্রতিফলন থাকে বাজেটে। বাংলাদেশের সংবিধানে বাজেট শব্দটি ব্যবহারের পরিবর্তে সমরূপ শব্দ ‘বার্ষিক আর্থিক বিবরণী’ ব্যবহার করা হয়েছে।

বাজেট হলো সরকারি অর্থব্যবস্থার মূল চালিকাশক্তি। বাজেটে যেমন সরকারের রাজনৈতিক দর্শনের প্রতিফলন ঘটে, তেমনি দেশের অর্থনীতির চিত্র ফুটে ওঠে। বাজেটে শুধু সরকারি সম্ভাব্য আয়-ব্যয়ের হিসাবই থাকে না; বরং আয়-ব্যয়ের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনাও এর অন্তর্ভুক্ত থাকে। যেমন- আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হলে কীভাবে ঘাটতি পূরণ হবে এবং ব্যয়ের চেয়ে আয় বেশি হলে সে উদ্বৃত্ত অর্থ দিয়ে কী করা হবে ইত্যাদি বিষয়ও বাজেটে লিপিবদ্ধ থাকে।

বাংলাদেশে সরকার বাজেট প্রণয়ন করে জাতীয় সংসদে উপস্থাপন করে। পরে জাতীয় সংসদে তা অনুমোদন নিতে হয় এবং চূড়ান্তভাবে রাষ্ট্রপতির সম্মতি নিয়ে সরকারের নির্ধারিত আয়-ব্যয় ও তার পদ্ধতি কার্যকর হয়।

বাজেট মূলত একটি অর্থবছরে সরকারের আয় এবং ব্যয়ের পরিকল্পনা। একজন ব্যক্তি যেমন আয় ও ব্যয়ের পরিকল্পনা করেন এবং বিভিন্ন খাত নির্দিষ্ট করেন, রাষ্ট্র ঠিক একইভাবে করে। ব্যক্তির আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হলে ঋণ করেন। সরকারও তাই করে। আবার পরবর্তী সময়ে আয় থেকে ঋণ পরিশোধ করে। সরকারকে আয় করতে হয় জনগণের কাছ থেকে। আবার ব্যয়ও করতে হয় জনগণের কল্যাণে। অন্যদিকে ঋণ করে দেশের ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে। বিদেশি সরকার ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেও সরকার ঋণ করে।

কারণ, কোনো দেশ ঠিকঠাকভাবে পরিচালনা করতে হলে, তার আয়-ব্যয়ের আগাম পরিকল্পনা থাকাটা জরুরি। সরকারি অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ, হাসপাতাল, রাস্তা-ঘাট, সেতু, বিদ্যুৎ প্রকল্প—সবকিছুতেই অর্থ খরচ হয়। আর সেই খরচের উৎস কোথা থেকে আসবে, তা বাজেটেই নির্ধারিত হয়।

দেশের সংবিধানেই বাজেট দেওয়ার বিধান রয়েছে। সংবিধানের ৮৭ অনুচ্ছেদে উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের জন্য সরকার যেসব কাজে অর্থ ব্যয় করবে এবং যেসব উৎস থেকে আয় বা প্রাপ্তি ঘটবে, তার কর্মপরিকল্পনা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সংবিধানের ওই অনুচ্ছেদে বাজেটকে বলা হয়েছে বার্ষিক আর্থিক বিবৃতি। জাতীয় সংসদের কার্যপ্রণালি বিধিতে ওই বিবৃতিকে ‘বাজেট’ হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে। বাজেটের ক্ষেত্রে বছর বলতে অর্থবছর। অর্থবছরের শুরু ১ জুলাই এবং শেষ পরের বছরের ৩০ জুন। বাজেট প্রণয়নের আইনি কাঠামো দিতে ২০০৯ সালে কার্যকর হয় বাজেট ব্যবস্থাপনা আইন।

উৎপাদন, উন্নয়ন ও কল্যাণ—একটি দেশের বাজেটের মূলত এই তিনটি প্রধান লক্ষ্য থাকে। এছাড়া নানা প্রাসঙ্গিক বিষয় নিয়ে দেওয়া বাজেটের মাধ্যমে একটি দেশের উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা থাকে। সেইসঙ্গে  প্রচেষ্টা থাকে উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করা।

যে কোনো বাজেটের দুটি দিক থাকে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ফিস্ক্যাল দিক আর একটি মানিটারি দিক। বাজেটে দেশের অর্থনীতির প্রায় সব দিকই বিবেচনায় নিতে হয়। বাজেটের মূল লক্ষ্য থাকে কয়েকটি। যেমন—জিডিপি প্রবৃদ্ধি কতটা অর্জিত হবে, মূল্যস্ফীতি কীভাবে সহনীয় পর্যায়ে রাখা যাবে, বাজেট ঘাটতি কীভাবে কমিয়ে আনা যাবে এবং দারিদ্র্যবিমোচন কীভাবে সম্ভব হবে।

বাংলাদেশের বাজেট প্রণয়ন করা হয় ১২ মাসের জন্য যা চলতি বছরের ১ জুলাই থেকে পরবর্তী বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত কার্যকর থাকে। প্রতি বছর জুন মাসে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে সরকারের পক্ষে অর্থমন্ত্রী বাজেট বিল পেশ করেন। এর আগে এই বাজেট বিল ক্যাবিনেট সভায় বিবেচনা ও অনুমোদন করা হয়।

অর্থ মন্ত্রণালয় বাজেট তৈরি করে থাকে। এ জন্য অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগ প্রয়োজনীয় উপকরণ সরবরাহ করে। মার্চ মাসে অর্থ মন্ত্রণালয় অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করে এবং মতামত নিয়ে চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট এবং পরের অর্থবছরের বাজেট প্রাক্কলনের প্রথম সংস্করণ চূড়ান্ত করে। এর আগে জানুয়ারি মাসে প্রতিটি মন্ত্রণালয় পরবর্তী অর্থবছরের বাজেটের জন্য নিজেদের ব্যয় পরিকল্পনা অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠায়। জুন মাসে নতুন অর্থবছরের বাজেট পেশের সময় সরকার চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেট দলিল প্রকাশ করে।

একটি অর্থবছরে সরকারের অনুমিত আয় এবং ব্যয়ের হিসাবই হলো বাজেট। একটি দেশের নির্বাচিত সরকারকে দেশের যখন দায়িত্ব দেওয়া হয়, তখন সরকার আগাম কিছু পরিকল্পনা করে দেশের ভবিষ্যত নির্ধারণ করে। যেটি আসলে বাজেটের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ রুপ পেয়ে থাকে। একটি নির্দিষ্ট বছরে কোথায় কত টাকা ব্যয় হবে, সেই পরিকল্পনার নামকেও বাজেট বলা হয়ে থাকে।

জাতীয় বাজেটের মূল অংশ দুটি। প্রথম অংশ রাজস্ব আদায় সংক্রান্ত। এই অংশে সরকারের রাজস্ব ব্যবস্থা ও আদায় সংক্রান্ত প্রস্তাবসমূহ থাকে, দ্বিতীয় অংশে থাকে সরকারি ব্যয়ের প্রস্তাবসমূহ। প্রতি বছর একটি আইনপ্রস্তাব বা ‘বিল’ আকারে জাতীয় বাজেট জাতীয় সংসদে উত্থাপন করা হয়। একে বলা হয় অর্থ বিল। সংসদ সদস্যরা অনুমোদনের পর এটি আইনে পরিণত হয়। বাংলাদেশে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড রাজস্ব প্রস্তাবসমূহ প্রণয়ন করে এবং অর্থ বিভাগ ব্যয় প্রস্তাবসমূহ প্রণয়ন করে।

 



বিষয়:


পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top