স্ত্রীর সঙ্গে শেষ কথা: “আমার ফোন বন্ধ পেলে ধরে নিও আমি মারা গেছি”
রাজবাড়ী প্রতিনিধি | প্রকাশিত: ১১ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৩৮

রাজবাড়ীর রামকান্তপুর চরপাড়া গ্রামের অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য নজরুল ইসলাম (৪৭) রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে প্রাণ হারিয়েছেন। দীর্ঘ সাত মাস ধরে নিখোঁজ থাকার পর অবশেষে গত ৮ অক্টোবর বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তার মৃত্যুর খবর জানানো হয় পরিবারকে। খবর পেয়ে তার বাড়িতে চলছে শোকের মাতম।
নিহত নজরুল ইসলাম সদর উপজেলার রামকান্তপুর চরপাড়া গ্রামের মৃত হাতেম আলী ফকিরের ছেলে। চার কন্যাসন্তানের জনক ছিলেন তিনি। বড় মেয়ে রাজবাড়ী সরকারি কলেজ থেকে এ বছর এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছে, দ্বিতীয় মেয়ে পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে, আর ছোট দুই মেয়ের বয়স ছয় ও পাঁচ বছর।
নজরুল ইসলাম বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ল্যান্স কর্পোরাল পদে কর্মরত ছিলেন এবং ২০২০ সালে অবসরে যান। ২০১৩ সালে তিনি জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নিতে কঙ্গো গিয়েছিলেন। অবসরের পর তিনি শ্রীপুর বাজারে মুদি ব্যবসা শুরু করলেও বড় লোকসানে পড়েন।
এ সময় স্থানীয় এক দালাল ফরিদ হোসেন তাকে রাশিয়ায় শপিংমলে নিরাপত্তাকর্মীর চাকরির প্রলোভন দেখান। স্ত্রী আইরিন আক্তার নানা উপায়ে বাধা দিলেও নজরুল বলেন, রাশিয়ায় ভালো বেতন পাবেন— সংসার ভালোভাবে চালাতে পারবেন।
২০২৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তিনি রাশিয়ার উদ্দেশে রওনা দেন। সেখানে পৌঁছে এক মাসের সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো হয় তাকে।
নজরুল নিয়মিত পরিবারের সঙ্গে ভিডিও কলে যোগাযোগ রাখতেন। সর্বশেষ ৩০ এপ্রিল স্ত্রীকে ফোনে জানান, তিনি ব্যাংকে টাকা পাঠাতে যাচ্ছেন। কিছুক্ষণ পর আবার ফোন করে বলেন—
“আমার আর টাকা পাঠানো হলো না, দ্রুত যেতে হচ্ছে। যদি ফোন বন্ধ পেয়ে থাকো, তাহলে ধরে নিও আমি আর বেঁচে নেই।”
এরপর থেকেই তার কোনো খোঁজ মেলেনি। দীর্ঘ সাত মাস পরিবারের সদস্যরা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন দপ্তরে যোগাযোগ করেও কোনো তথ্য পাননি। অবশেষে গত ৮ অক্টোবর বিকেলে ফোনে জানানো হয়, নজরুল ইসলাম মারা গেছেন।
স্ত্রী আইরিন আক্তার কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন—
“আমি বারবার নিষেধ করেছিলাম। বলেছিলাম, সন্তানদের নিয়ে আমরা একসাথে থাকব। কিন্তু সে বলল, রাশিয়ায় ভালো চাকরি আছে, নিরাপত্তা প্রহরীর কাজ। এখন চার মেয়েকে নিয়ে কিভাবে বাঁচব? আমার একটাই চাওয়া— সরকার যেন আমার স্বামীর লাশটা দেশে আনার ব্যবস্থা করে। শেষবার একটু দেখতে চাই।”
নজরুলের বড় ভাই অবসরপ্রাপ্ত সার্জেন্ট রহিম বলেন,
“ফরিদ নামের দালাল আমার ভাইকে প্রলুব্ধ করে রাশিয়ায় পাঠিয়েছে। বহু জায়গায় খোঁজ নিয়েছি, কিন্তু সে সবসময় বলত— ও বেঁচে আছে, যোগাযোগ করতে পারছে না। এখন শুনলাম, ও আর নেই।”
তিনি সরকারের কাছে অনুরোধ জানান— নজরুলের মরদেহ যেন দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনা হয়।
অভিযুক্ত ফরিদ হোসেন বলেন,
“নজরুলকে আমি সরাসরি পাঠাইনি। সে বিকন ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলসের মাধ্যমে গেছে। আমি শুধু যোগাযোগ করিয়ে দিয়েছি। সব জেনে-শুনেই সে রাশিয়ান সেনাবাহিনীর লজিস্টিক হ্যান্ড হিসেবে গেছে।”
রাজবাড়ী সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মারিয়া হক জানান,
“এ ব্যাপারে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অফিসিয়ালি কিছু জানানো হয়নি। তবে আমি বিষয়টি খোঁজ নিচ্ছি এবং নজরুলের পরিবারের সঙ্গে কথা বলে লাশ ফেরতের বিষয়ে উদ্যোগ নিচ্ছি।”
বিষয়:
পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।