বৃহঃস্পতিবার, ৯ অক্টোবর ২০২৫, ২৪ আশ্বিন ১৪৩২

সুনামগঞ্জে ভূমিকম্পের ঘনঘটা:

ডাউকি ফল্টে জমছে শক্তি, বড় ভূমিকম্পের আশঙ্কা

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি ● | প্রকাশিত: ৯ অক্টোবর ২০২৫, ১০:৫৯

ছবি: সংগৃহীত

গত দুই বছরে সুনামগঞ্জে মাঝারি ও স্বল্পমাত্রার অন্তত পাঁচটি ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে। ভূতত্ত্ববিদরা বলছেন, এই ঘনঘন কম্পনগুলো বড় ভূমিকম্পের আগাম সতর্ক সংকেত হতে পারে। কারণ, জেলার উৎপত্তিস্থলগুলো বাংলাদেশের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ ভূমিকম্প অঞ্চল ডাউকি ফল্ট লাইনের ওপর অবস্থিত।

বিশেষজ্ঞদের মতে, শতবর্ষ ধরে এই ফল্টে বিপুল পরিমাণ শক্তি জমে আছে, যা একসময় ৮ মাত্রারও বেশি শক্তিশালী ভূমিকম্পের জন্ম দিতে পারে। ১৮৯৭ সালের ভয়াবহ ‘গ্রেট ইন্ডিয়া আর্থকোয়েক’-এ সুনামগঞ্জসহ পুরো উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছিল। শুধু সুনামগঞ্জেই মারা যান ২৮৭ জন।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি (৩.৫ মাত্রা) ও ১৪ মে (৩.৫ মাত্রা) সিলেট-সুনামগঞ্জ অঞ্চলে দুই দফা ভূকম্পন অনুভূত হয়। উভয়টির উৎপত্তিস্থল ছিল সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজভাগ ও সুনামগঞ্জের শাল্লা। এর আগে ২০২৪ সালের ৩ ফেব্রুয়ারিতে সুনামগঞ্জের জগন্নাথপুরে দুটি ৩.৪ মাত্রার ভূমিকম্প রেকর্ড হয়।

গত দুই বছরে সুনামগঞ্জেই পাঁচটি ভূমিকম্পের উৎপত্তি হওয়ায় স্থানীয়ভাবে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ছোট ছোট এই কম্পনগুলো অদৃশ্যভাবে হলেও ভূমিকম্প ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।

ভূতত্ত্ববিদ ড. মোহাম্মদ সফিকুল ইসলাম বলেন, “ডাউকি ফল্ট খুব সক্রিয় ও বিপজ্জনক একটি জোন। সুনামগঞ্জ, সিলেট ও ময়মনসিংহ এই ফল্টের ওপর অবস্থিত। এখানে প্রচুর শক্তি সঞ্চিত হচ্ছে, যা বড় ভূমিকম্পের সম্ভাবনা তৈরি করছে।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. কাজী মতিন উদ্দিন আহমেদ জানান, “সুনামগঞ্জ ভূমিকম্পের উচ্চ ঝুঁকিতে রয়েছে। এখানে ‘তরলীকরণ’ (Liquefaction) ঝুঁকি বেশি— ভূমিকম্পের সময় পানিসিক্ত মাটি তরলের মতো আচরণ করতে পারে, ফলে ভবন বা সড়ক হেলে পড়া বা ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে।”

২০২১ সালে বুয়েটের সহায়তায় পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা যায়, সুনামগঞ্জ পৌরসভার ২ নম্বর ওয়ার্ডের ৪৯ শতাংশ ভবন ভূমিকম্পের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। সমীক্ষায় আরও উল্লেখ করা হয়, এলাকাবাসীর ৭৩ শতাংশ শিক্ষিত হলেও ভূমিকম্প প্রস্তুতি সম্পর্কে তাঁদের সচেতনতা কম।

শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. মুশতাক আহমদ বলেন, “সুনামগঞ্জের ভূমি নরম হওয়ায় এবং ভবন নির্মাণে সঠিক নীতিমালা অনুসরণ না করায় ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকি অনেক বেশি।”

সুনামগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) সমর কুমার পাল বলেন, “ঝুঁকি হ্রাসে করণীয় নির্ধারণে সম্প্রতি ভূমিকম্প বিশেষজ্ঞদের উপস্থিতিতে কর্মশালা করা হয়েছে। সচেতনতা বৃদ্ধি ও আগাম প্রস্তুতি বাড়াতে কাজ চলছে।”

বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী, ভূমিকম্পের আগাম সতর্কতা জানাতে সেন্সর নেটওয়ার্ক স্থাপন ও মোবাইল বার্তার পাশাপাশি স্কুল ও কমিউনিটি সেন্টারে লাউডস্পিকারের মাধ্যমে সতর্কতা প্রচারের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণায় দেখা গেছে, ইন্ডিয়া প্লেট পূর্ব দিকে বার্মা প্লেটের নিচে তলিয়ে যাচ্ছে— আর বার্মা প্লেট পশ্চিম দিকে অগ্রসর হচ্ছে। শতাব্দীজুড়ে শক্তি নির্গমন না হওয়ায় সেখানে জমা শক্তির পরিমাণ ভয়াবহ মাত্রায় পৌঁছেছে। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করছেন, এই শক্তি একসময় ৮ মাত্রার বেশি ভূমিকম্প ঘটাতে পারে।



বিষয়:


পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top