মঙ্গলবার, ৯ ডিসেম্বর ২০২৫, ২৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩২

বেগম খালেদা জিয়ার সংকটময় শারীরিক অবস্থা, জাতির মনে গভীর উদ্বেগ

ব্রি জে (অব.) এইচ আর এম রোকন উদ্দিন | প্রকাশিত: ৭ ডিসেম্বর ২০২৫, ১৬:৩৩

গ্রাফিক্স | নিউজফ্ল্যাশ সেভেন্টিওয়ান

বাংলাদেশের আধুনিক রাজনৈতিক ইতিহাসে যেসব নেতার নাম মানুষের হৃদয়ে গভীরভাবে লিপিবদ্ধ রয়েছে, বেগম খালেদা জিয়া তাদের অন্যতম। বর্তমানে তিনি জীবনের কঠিনতম লড়াইয়ে রয়েছেন, আর এ পরিস্থিতি দেশজুড়ে সৃষ্টি করেছে অস্থিরতা ও উদ্বেগ। রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে দেশের মানুষ তার সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করছেন।

তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে দেশের রাজনীতিতে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব ১৯৯১ সালে প্রথম বড় পরীক্ষার মুখোমুখি হয়। দীর্ঘ সামরিক শাসনের পর ভঙ্গুর গণতন্ত্র, দুর্বল অর্থনীতি এবং অরাজক প্রশাসনিক কাঠামোর মধ্যে দেশকে স্থিতিশীল করতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

১৯৯১ সালের গণভোটের মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি শাসনব্যবস্থা বাতিল করে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা তার অন্যতম বড় সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই সিদ্ধান্ত দেশের ক্ষমতার ভারসাম্য জনগণের হাতে ফেরত দেয় এবং আধুনিক বাংলাদেশ গঠনের ভিত্তি তৈরি করে।

তার আমলে বাজারভিত্তিক অর্থনৈতিক নীতির ভিত্তি দৃঢ় হয়। ১৯৯১–১৯৯৬ মেয়াদে গার্মেন্টস খাত দ্রুত সম্প্রসারিত হয়ে রপ্তানি তিনগুণে উন্নীত হয়। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্বিগুণের বেশি বৃদ্ধি পায় এবং মাথাপিছু আয়ে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেখা দেয়।

নারীশিক্ষায় তার গ্রহণ করা ফিমেইল সেকেন্ডারি স্কুল অ্যাসিস্ট্যান্স প্রোগ্রাম দেশব্যাপী মেয়েদের স্কুলে ভর্তি হার বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ইউনেস্কোসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এ উদ্যোগের প্রশংসা করে।

বিদেশনীতি পরিচালনায় তিনি সমতা, মর্যাদা ও জাতীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেন। সীমান্ত, জলবণ্টন, বাণিজ্যসহ বিভিন্ন ইস্যুতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ককে ভারসাম্যপূর্ণ রাখতে ভূমিকা রাখেন।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন মামলায় তার গ্রেপ্তার ও কারাবাস তার শারীরিক অবস্থার অবনতির পেছনে বড় ভূমিকা রাখে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এসব মামলাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে বর্ণনা করেছে—এমন দাবিও রাজনৈতিক মহলে পাওয়া যায়।

চিকিৎসা বঞ্চনা, কারাগারের পরিবেশ এবং দীর্ঘদিনের অসুস্থতা মিলিয়ে গত কয়েক বছর ধরে তার শারীরিক অবস্থা ক্রমেই জটিল হয়ে ওঠে। বর্তমানে তার শারীরিক সংকটকে অনেকেই রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত ও অতীত রাজনৈতিক পরিস্থিতির পরিণতি হিসেবে দেখছেন।

বেগম জিয়ার অনুপস্থিতি বিএনপির ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে। দলের সিনিয়র নেতৃত্বে চাপা মতপার্থক্য বাড়ার আশঙ্কা থাকলেও তার ত্যাগ ও জীবনসংগ্রাম নতুন প্রজন্মের নেতাকর্মীদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা তৈরি করতে পারে। এতে দল পুনরায় সংগঠিত হওয়ার সুযোগও পেতে পারে।

রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, তার মৃত্যু—যদি ঘটে—দেশের রাজনীতিতে নতুন অস্থিরতা, নতুন ক্ষমতার ভারসাম্য ও সম্ভাব্য নতুন জোট বিন্যাসের পথ তৈরি করতে পারে।

দেশের সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক শ্রেণি—সবাই তার সুস্থতার জন্য প্রার্থনা করছেন। তাদের মতে, তার সুস্থতা শুধু একজন নেত্রীর পুনরুদ্ধার নয়; বরং জাতির স্বাভাবিক পথে ফেরার প্রত্যাশা।

বাংলাদেশ আজ অপেক্ষায়—ইতিহাস কি তাকে আরেকবার উঠে দাঁড়ানোর সুযোগ দেবে? কারণ অনেকের চোখে তিনি শুধু একজন রাজনৈতিক নেত্রী নন; তিনি বাংলাদেশের গণতন্ত্র, ত্যাগ, সংগ্রাম ও মর্যাদার প্রতীক।



বিষয়:


পাঠকের মন্তব্য

মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।

Top