গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের রাজনীতিতে আসন্ন নির্বাচন
কৃষিবিদ মোঃ আতিকুর রহমান | প্রকাশিত: ২২ ডিসেম্বর ২০২৫, ১০:৫৯
বাংলাদেশের রাজনীতি বর্তমানে এক গভীর নির্বাচনী সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অচলাবস্থা, পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং অংশগ্রহণমূলক রাজনৈতিক কাঠামোর ক্রমাগত সংকোচন রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাকে বহুমাত্রিক চাপে নিক্ষেপ করেছে।
এই বাস্তবতায় আসন্ন জাতীয় নির্বাচন কোনো প্রথাগত রাজনৈতিক আয়োজন নয়; বরং এটি গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার এক গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় পরীক্ষা।
গণতন্ত্রের বৈধতা জনগণের সম্মতির মধ্যেই নিহিত, আর সেই সম্মতির সবচেয়ে প্রাতিষ্ঠানিক ও স্বীকৃত প্রকাশ ঘটে নির্বাচনের মাধ্যমে। যখন নির্বাচনী প্রক্রিয়ার বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষুণ্ন হয়, তখন কেবল একটি সরকার নয়—পুরো রাষ্ট্রব্যবস্থাই বৈধতার সংকটে পতিত হয়। এর অভিঘাত সংসদের কার্যকারিতা, নীতিনির্ধারণের গ্রহণযোগ্যতা এবং সামগ্রিক রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর অনিবার্যভাবে প্রতিফলিত হয়। বর্তমান প্রেক্ষাপটে এই সংকট উপেক্ষার কোনো সুযোগ নেই।
রাজনীতিতে প্রতিযোগিতা অনিবার্য এবং তা গণতন্ত্রের স্বাভাবিক শর্ত। তবে সেই প্রতিযোগিতা যদি অংশগ্রহণহীন ও নিয়ন্ত্রিত কাঠামোর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তাহলে তা গণতান্ত্রিক বিকাশ নয়; বরং ক্ষমতার একরৈখিক পুনরুৎপাদন ঘটায়। সামনের নির্বাচন সেই বাস্তবতারই এক কঠিন পরীক্ষা—যেখানে প্রমাণিত হবে রাষ্ট্র রাজনৈতিক প্রতিযোগিতাকে কতটা উন্মুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও গ্রহণযোগ্য রাখতে সক্ষম।
এই প্রক্রিয়াকে আরও জটিল করে তুলেছে রাজনীতিতে মব ভায়োলেন্সের ক্রমবর্ধমান ব্যবহার এবং এর নীরব প্রশ্রয়। দলীয় আবেগ, প্রতিশোধপরায়ণ মানসিকতা কিংবা তাৎক্ষণিক শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে রাজনীতি পরিচালিত হলে তা আইনের শাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে দুর্বল করে। মব কালচার রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান নয়; বরং এটি সংঘাতকে গভীরতর করে এবং সহিংসতার ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়ে তোলে। দায়িত্বশীল রাজনীতির জন্য এই প্রবণতা থেকে সুস্পষ্টভাবে সরে আসা অপরিহার্য।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা কখনোই জোরপূর্বক আরোপ করা যায় না। এটি জন্ম নেয় রাজনৈতিক সমঝোতা, সাংবিধানিক শাসনের প্রতি আনুগত্য এবং জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সেই সমঝোতার ন্যূনতম ভিত্তি নির্মাণ করতে পারে। নির্বাচন-পূর্ব পরিবেশের স্বচ্ছতা, প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা এবং নিরাপদ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড—এই সমন্বয়ই একটি নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নির্ধারণ করে।
এই ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকা নির্ধারণমূলক। নির্বাচন কমিশনের কার্যকর ও স্বাধীন ভূমিকা, প্রশাসনের পেশাদার আচরণ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষতা নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে। একই সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলোর ওপরও গুরুতর দায়িত্ব বর্তায়—রাজপথের উত্তেজনা নয়, বরং রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থা স্থাপনই হওয়া উচিত প্রধান কৌশল।
ভিন্নমত ও মতাদর্শিক বিরোধ গণতন্ত্রের শক্তি। কিন্তু সেই ভিন্নমত যদি রাষ্ট্রবিরোধী বিভাজনে রূপ নেয়, তবে তা জাতীয় স্বার্থের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। বর্তমান সময়ে প্রয়োজন মতাদর্শগত পার্থক্য সত্ত্বেও একটি ন্যূনতম রাজনৈতিক ঐকমত্য—যেখানে শান্তিপূর্ণ নির্বাচন, জনগণের ভোটাধিকার এবং সাংবিধানিক পথের প্রতি সর্বসম্মত অঙ্গীকার থাকবে।
সামনের নির্বাচন সেই ঐকমত্যে পৌঁছানোর একটি বিরল সুযোগ। এখানে প্রশ্ন কেবল কে ক্ষমতায় যাবে তা নয়; বরং ক্ষমতায় যাওয়ার পথটি কতটা গণতান্ত্রিক, কতটা বৈধ ও কতটা গ্রহণযোগ্য—সেটিই মূল বিবেচ্য। একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন রাজনৈতিক উত্তেজনা প্রশমিত করতে পারে, রাষ্ট্রকে দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতা থেকে বের করে আনতে পারে এবং ভবিষ্যৎ রাজনীতির জন্য একটি ইতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে সক্ষম।
সবশেষে বলা যায়, গণতন্ত্র রক্ষার দায় কোনো একক পক্ষের নয়। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও ভবিষ্যৎ নির্বাচনকালীন সরকার, বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং নাগরিক সমাজ—সবার সম্মিলিত ও ন্যায়ানুগ উদ্যোগেই রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে। বিভাজনের রাজনীতি নয়, গণতান্ত্রিক নীতির প্রশ্নে এক সুরে অবস্থান নেওয়াই আজ সময়ের অপরিহার্য দাবি।
কারণ গণতন্ত্র দুর্বল হলে রাষ্ট্রও দুর্বল হয়, আর গণতন্ত্র সুদৃঢ় হলে রাষ্ট্র শক্ত ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হয়। সামনের নির্বাচন সেই সুদৃঢ় ভিত্তি নির্মাণের এক গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ—যা হারানোর নয়, বরং দায়িত্বশীলতার সঙ্গে গ্রহণ করাই আজকের প্রধান রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ।
লেখক:
কৃষিবিদ মোঃ আতিকুর রহমান
শিক্ষার্থী, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়
বিষয়:

পাঠকের মন্তব্য
মন্তব্য পাঠকের একান্ত ব্যক্তিগত। এর জন্য সম্পাদক দায়ী নন।